উন্মত্ত - দারুণ উত্তেজনায় আবেগবিহ্বল, ক্ষিপ্ত। শোভিত – সজ্জিত, উদ্যান - বাগান। উদ্যত- প্রবৃত্ত, প্রস্তুত। বিমুখ প্রান্তরে- বিরুদ্ধ পরিবেশের মাঠ, প্রতিকূল পরিবেশে। দিগন্ত প্লাবিত – আকাশ-ছোঁয়া, যে মাঠে দিগন্ত এসে মিশেছে এমন বিশাল। দুর্বাদলে – সবুজ ঘাসে। উলঙ্গ কৃষক – খালিগায়ের দরিদ্র গ্রামীণ কৃষক। করুণ কেরানি – স্বল্প বেতনে দারিদ্র্যের মধ্যে করুণভাবে জীবন-যাপনকারী সাধারণ চাকরিজীবী কেরানি। ভবঘুরে- যাদের কোনো কাজকর্ম নেই, বেকার। পাতা-কুড়ানিরা- যারা পাতা-কুড়িয়ে জীবন ধারণ করে। দরিদ্র কিশোর-কিশোরীর দল। পলকে – মুহূর্তের মধ্যে। দারুণ ঝলকে – প্রচণ্ড ঝলক দিয়ে, প্রচণ্ড আলোর দোলা লাগিয়ে। গণসূর্যের মঞ্চ - জনগণের নেতা, যাঁর তেজীয়ান দ্যুতি চারদিকে বিচ্ছুরিত হচ্ছিল তিনি যেন এক গণসূর্য। মঞ্চ সেই নেতা যে মঞ্চে দাঁড়িয়ে সেটা তো গণসূর্যের মঞ্চ। তাছাড়া সেদিন বিকেলে সূর্যের আলোতে ছিল প্রখরতা। রোধে -বন্ধ করে দেওয়া, বাধা দেওয়া। সবুজ - সবুজময় – সবুজ ঘাসে আবৃত। প্রাণের সবুজ – প্রাণের সজীবতা ও তারুণ্য। মাঠের সবুজ – মাঠের সুন্দর সবুজ পরিবেশ। বজ্রকণ্ঠ – মেঘাচ্ছন্ন আকাশ থেকে বজ্র বা বিদ্যুতের ধ্বনি প্রচণ্ড শক্তিধর শব্দের মতো। এখানে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্বরকে বোঝানো হয়েছে। লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা -১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বাংলার মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠনিঃসৃত বক্তব্য শোনার জন্য ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে অপেক্ষা করছিল লক্ষ লক্ষ মানুষ। তারা ব্যাকুল হয়ে বসেছিল বঙ্গবন্ধুর অপেক্ষায় । রেসকোর্সের মাঠে এসে তিনি কী নির্দেশ দেন, কী আশার বাণী শোনান সে জন্য সেদিন লক্ষ প্রাণ হয়েছিল আকুল। কারণ পাকিস্তানি শাসকরা সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের বিজয়কে নস্যাৎ করার সমস্ত পরিকল্পনার ছক তৈরি করে বসেছিল। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির বিজয়কে তারা স্বীকার করে নিতে পারেনি। পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রকারীদের সামরিক প্রতিভূ ইয়াহিয়া খান ১৯৭১-এর ১লা মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত করে দেয়। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে শুরু হয় সমগ্র বাঙালি জাতির ঐক্যবদ্ধ অসহযোগ আন্দোলন । বাংলাদেশ হয়ে ওঠে গণমানুষের আন্দোলনে টালমাটাল। ক্ষুব্ধ দেশের মানুষ। ফেটে পড়ছে তাদের ক্রোধ। তারা তাকিয়ে আছে তাদের অকৃত্রিম বন্ধু, প্রাণের মানুষ, কোটি মানুষের নেতা শেখ মুজিবের দিকে। সমস্ত দেশের মানুষ যেন এ বিদ্রোহে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সেদিন রেসকোর্সের মাঠে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শোনার জন্য যারা এসেছিল সেই লক্ষ লক্ষ মানুষের মনে ছিল ব্যাকুলতা, বঙ্গবন্ধু কী বলবেন আজ। প্রত্যেক শ্রোতাই যেন এক একজন বিদ্রোহী । এ বিদ্রোহ ছিল পাকিস্তানি স্বৈরশাসক ও সামরিকতন্ত্রের এবং অন্যায় ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে। জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে – রমনা রেসকোর্সে সমবেত লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশকে কবি কল্পনা করেছেন জনসমুদ্রের বাগানরূপে। সেই জনসমুদ্রের একদিকে ছিল মঞ্চ, কবির দৃষ্টিতে সেটি যেন সেই জনসমুদ্রের তীর । এই শিশু পার্ক সেদিন ছিল না- বর্তমানে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উত্তরপ্রান্তের একটি অংশজুড়ে রয়েছে শিশু পার্ক। তখন এ শিশু পার্ক ছিল না, তখন এর নাম ছিল রমনা রেসকোর্স। এই রেসকোর্সের উত্তর প্রান্তে নির্মিত বিরাট প্রশস্ত মঞ্চ থেকে ৭ই মার্চ (১৯৭১) বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সেই স্মৃতিময় স্থানটির কোনো অস্তিত্ব এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেখানে এখন নানা রঙ- বেরঙের টুল-বেঞ্চি, খেলনারাজ্য, আর চারদিকে বাগান। কবি মনে করেন, লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয় নিংড়ানো “স্বাধীনতা সংগ্রামের বাণী' যেখান থেকে উচ্চারিত হয়েছিল সে স্মৃতিময় স্থানটি এভাবেই সুকৌশলে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। কখন আসবে কবি? – বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কল্পনা করা হয়েছে কবিরূপে । কারণ তিনি বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার স্বপ্ন ও অনুভূতির রূপকার। তাঁর বাঙালি হৃদয়ের আবেগপ্রবণ প্রকাশকে কবিসুলভই মনে হয়। ১৯৭১ সালের ৫ই এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘নিউজউইক' পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ‘রাজনীতির কবি' বলে আখ্যায়িত করে লেখা হয়, তিনি ‘লক্ষ লক্ষ মানুষকে আকর্ষণ করতে পারেন সমাবেশে এবং আবেগময় বাগ্মিতায় তরঙ্গের পর তরঙ্গে তাদের সম্মোহিত করে রাখতে পারেন। তিনি রাজনীতির কবি'। সুতরাং বঙ্গবন্ধুকে 'কবি' অভিধাটি যথার্থভাবেই দিয়েছেন একালের কবি। কবির বিরুদ্ধে কবি ... মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ – কবি এখানে বোঝাতে চেয়েছেন বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর এদেশে অশুভশক্তির যে উত্থান ঘটেছে তাতে সব ইতিবাচক ভাবনা, সৌন্দর্য ও কল্যাণকে যেন সমাহিত করার প্রয়াস চলেছে। শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প – ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে যে বিকেলটিতে লক্ষ লক্ষ মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য, সে বিকেলটি কবির দৃষ্টিতে ছিল বাংলার মানুষের জন্য শ্রেষ্ঠ বিকেল। কারণ এদিন বিকেলেই তিনি স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে – প্রকৃতপক্ষে বাংলার স্বাধীনতাসূর্য অস্তমিত হয় পলাশির প্রান্তরে ১৭৫৭ সালে। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন হয়—সিপাহী বিপ্লব। ১৯৩০ সালে চট্টগ্রামে স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবী সূর্য সেনের নেতৃত্বে ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র যুদ্ধ হয় জালালাবাদ পাহাড়ে। অতঃপর পাকিস্তান সৃষ্টির এক বছর পর থেকে শুরু হয় পাকিস্তানি শাসকদের নানা ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। ১৯৪৮ সালের ভাষা সংগ্রাম থেকে ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন, তারপর ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। সুতরাং ইতিহাসের বহু অধ্যায় পার হয়ে, নানা সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি প্রিয় স্বাধীনতা। অতঃপর কবি এসে মঞ্চে দাঁড়ালেন - বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতামঞ্চে এসে দাঁড়ালেন লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে। তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল/হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার/সকল দুয়ার খোলা, – কবি তাঁর বর্ণনাকে আরও সুন্দর ও অর্থবহ করে তোলার জন্য রবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার গ্রাস' ও বিষ্ণু দে'র ‘ঘোড়সওয়ার' কবিতার চরণ ব্যবহার করেছেন খুব নৈপুণ্যের সঙ্গে । বাংলার মানুষের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বাধীনতারূপী নৌকার পাল তুলে যখন ডাক দিলেন, তখন জনতার জোয়ারের স্রোতে সে নৌকায় লাগল উদ্দাম হাওয়া, ছুটে চলল সেই স্বপ্নের বহু আকাঙ্ক্ষিত তরী। বজ্রকণ্ঠ বাণী- সহজে উদ্দীপ্ত দ্যুতিময় বঙ্গবন্ধুর বাণী। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির - সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম- ১৯৭১-এর ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেন, এদেশের মুক্তির ডাক দেন। তাঁর বক্তব্যের এটাই ছিল মূলকথা। তাঁর এ আহ্বানে সমগ্র দেশবাসী ঐক্যবদ্ধ হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং অবশেষে আমরা জয়ী হই। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক এই ভাষণটি বিশ্ববিশ্রুত। ২০১৭ সালের ৩০ শে অক্টোবর ভাষণটিকে ইউনেস্কো ‘ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল' হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের – ‘স্বাধীনতা' শব্দটি এখন অভিধানের একটি নিছক শব্দ নয়। এ শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে আমাদের সংগ্রাম ও মুক্তির প্রসঙ্গ যুক্ত। তাই ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ যখন বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ থেকে ধ্বনিত হলো : এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, তখন ‘স্বাধীনতা' শব্দটি পেল নতুন অর্থ ও ব্যঞ্জনা ।
আরও দেখুন...